কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে স্বর্ণলতা পরিবহনের চলন্ত বাসে ইবনে সিনা হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স (সেবিকা) শাহীনূর আক্তার তানিয়াকে গণধর্ষণ শেষে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষকরা তাঁকে খুন করার জন্য মাথার পেছনে ভারী বস্তু দিয়ে আঘাত করে।
এতে তানিয়ার মাথার খুলি আলাদা হয়ে যায়। এ কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তিনি দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। গতকাল বুধবার চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাটিকে দুর্ঘটনা বলে চালাতে চেয়েছে দুর্বৃত্তরা। লোক দেখানো চিকিৎসার জন্য দুর্বৃত্তরা মুমূর্ষুপ্রায় তানিয়াকে পিরিজপুর বাজারের যে ফার্মেসিতে নিয়ে যায়, সেই ফার্মেসি মালিক কালের কণ্ঠকে নতুন তথ্য দিয়েছেন। ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় বাজিতপুর থানায় দায়ের হওয়া মামলায় আটক পাঁচ আসামিকেই আদালত আট দিন করে রিমান্ডে পাঠিয়েছেন। অন্যদিকে মামলার এজাহারে এক ব্যবসায়ীর নাম অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তানিয়ার বাবা গিয়াস উদ্দিন এ ঘটনায় চারজনের নাম উল্লেখ করে গত মঙ্গলবার রাতে মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামিরা হলো বাসচালক গাজীপুরের কাপাসিয়ার মৃত গিয়াস উদ্দিনের ছেলে নূরুজ্জামান ওরফে নূর মিয়া ও হেলপার একই এলাকার মৃত আব্দুল হামিদের ছেলে লালন মিয়া, তাদের সহকারী ভেঙ্গুরদি গ্রামের অহিদুজ্জামানের ছেলে আল-আমিন এবং বাজিতপুরের পিরিজপুর বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
পুলিশ এ ঘটনায় মামলার এজাহারভুক্ত চালক ও হেলপার ছাড়াও কাপাসিয়ার লোহাদি গ্রামের নজর আলীর ছেলে রফিকুল ইসলাম রফিক, কটিয়াদীর ভোগপাড়া গ্রামের দুলাল মিয়ার ছেলে খোকন মিয়া ও বাজিতপুরের পিরিজপুর গ্রামের মৃত আব্দুস শহীদ ভূঁইয়ার ছেলে বকুল মিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল তাদের কিশোরগঞ্জ আদালতে হাজির করে ১০ দিন রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাজিতপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সারোয়ার জাহান আবেদনে উল্লেখ করেন, ওই পাঁচজন মিলে তানিয়াকে বাসের ভেতর পালাক্রমে ধর্ষণের পর হত্যা করেন। এসব অপরাধের কথা তারা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে। মামলার পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার এবং স্বর্ণলতা পরিবহনের বাসটি উদ্ধারের জন্য গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আল মামুন আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এদিকে কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা তাঁকে জানিয়েছেন যে মেয়েটিকে গণধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এরপর ভারী বস্তু দিয়ে মাথার পেছন দিকে সজোরে আঘাত করা হয়। এতে মাথার পেছন দিকের খুলি অনেকটা আলাদা হয়ে যায়। এ কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মেয়েটি অতি দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
গত মঙ্গলবার দুপুরে কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে তানিয়ার মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ময়নাতদন্তে ধর্ষণ ও আঘাতজনিত কারণে তানিয়ার মৃত্যুর আলামত পাওয়া যায়। এ ছাড়া ডিএনএ ও প্যাথলজিক্যাল টেস্টের জন্য আলামত সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে।
সততা ফার্মেসির মালিক যা বললেন : পিরিজপুর বাজারের সততা ফার্মেসির মালিক হাবিবুর রহমান বলেন, গত সোমবার রাত অনুমান সাড়ে ৮টার দিকে তিন ব্যক্তি স্বর্ণলতা বাস থেকে মেয়েটিকে নামিয়ে পাঁজাকোলা করে তাঁর ফার্মেসিতে নিয়ে আসে। তারা বলে, মেয়েটি নাকি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘তারা আমার ফার্মেসিতেই মেয়েটিকে ফেলে রেখে চলে যেতে চেয়েছিল। তখন মেয়েটি জীবিত কি মৃত বোঝা যাচ্ছিল না। আমি তাদের বলি, আপনারা মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যান। এরপর তারা একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় মেয়েটিকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওই বাসেই মেয়েটিকে তুলে দেওয়া হয়। আমার ধারণা, তাদের মধ্যে দুজন ছিল চালক ও হেলপার।’
ঘটনা অন্যদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা : এদিকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডকে দুর্ঘটনা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। কিশোরগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মাশরুকুর রহমান খালেদ মঙ্গলবার কটিয়াদী থানায় অবস্থানকালে কালের কণ্ঠকে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে বাসের চালক ও হেলপার তাঁকে জানিয়েছে যে বাসের সব যাত্রী নেমে পড়লে বাসের একমাত্র যাত্রী ছিলেন মেয়েটি। বাসটি বিলপাড় গজারিয়া এলাকায় যাওয়ামাত্র মেয়েটি ভয় পেয়ে চলন্ত বাস থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে আহত হন। অবশ্য চালক ও হেলপারের বক্তব্যের সূত্র ধরে পুলিশ সুপার মন্তব্য করেন—এমনি এমনি কেউ ভয় পেয়ে বাস থেকে লাফ দেয় না। এদিকে মামলায় পিরিজপুরের স্বচ্ছ ভাবমূর্তির শিক্ষিত যুবক আব্দুল্লাহ আল মামুনকে আসামি করায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। নাম প্রকাশ না করে একাধিক ব্যক্তি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিরপরাধ কাউকে এভাবে আসামি করলে মামলাটি দুর্বল হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে এমন নৃশংস ঘটনার তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম ব্যাহত হবে।’
মামলার এজাহারভুক্ত আসামি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘এটা অন্যায়ভাবে আমাকে ফাঁসানোর নিকৃষ্ট প্রচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। আমি এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই এবং ষড়যন্ত্রকারী মহলের শাস্তি চাই।’
তবে বাজিতপুর থানার ওসি খলিলুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘বাদী যেভাবে মামলা দিয়েছেন আমরা ঠিক সেভাবেই মামলাটি রেকর্ড করেছি। ঘটনাটির নিবিড় তদন্ত করছে পুলিশ।’
মামলার বাদী তানিয়ার বাবা গিয়াস উদ্দিন চালক ও হেলপারসহ তিন আসামির নাম বলতে পারলেও কালের কণ্ঠ’র কাছে চতুর্থ আসামির নাম বলতে পারেননি। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেডা জানে হে (ছেলে) কী করছে!’
তানিয়ার বাড়িতে চলছে মাতম : সবার আদরের তানিয়া বাড়ি ফিরছে। তাই বাড়িতে ছিল উৎসবের আমেজ। বাড়িজুড়ে বাবা গিয়াস উদ্দিনের ব্যস্ততা ও হাঁকডাক অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশিই ছিল। বড় ভাই শফিকুল ইসলাম সবুজ (২৭) বোনের বাড়ি আসা উপলক্ষে গরুর মাংস কিনে এনেছিলেন, বোনকে নিয়ে একসঙ্গে খাবেন বলে। কিন্তু সেই বোন বাড়িতে এলেন লাশ হয়ে। এখন পুরো বাড়িতে চলছে মাতম।
ময়নাতদন্ত শেষে তানিয়ার লাশ মঙ্গলবার রাতেই মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়। গতকাল তানিয়াদের বাড়ি কটিয়াদীর লোহাজুরি ইউনিয়নের বাহেরচরে গিয়ে দেখা যায়, বাবা গিয়াস উদ্দিন মেয়ের কবরের সামনে ‘তানিয়া তানিয়া’ বলে বিলাপ করছেন। স্থানীয়রা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
পাকুন্দিয়ায় বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ : পাকুন্দিয়া (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কটিয়াদীতে চলন্ত বাসে নার্স শাহীনূর আক্তার তানিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যায় জড়িতদের ফাঁসির দাবিতে পাকুন্দিয়ায় মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। গতকাল সকাল ১১টার দিকে পাকুন্দিয়া সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের উদোগে উপজেলা পরিষদ গেটের সামনে কিশোরগঞ্জ-ঢাকা সড়কে এই কর্মসূচি পালন করা হয়। আধাঘণ্টাব্যাপী অবরোধ চলাকালে রাস্তার দুই পাশে যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে উপজেলা চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রেনু ও ইউএনও মোহাম্মদ মোকলেছুর রহমান এবং থানা পুলিশ শিক্ষার্থীদের শান্ত করলে তারা অবরোধ তুলে নেয়।
এ সময় উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, এসব অপরাধীকে প্রকাশ্যে ক্রসফায়ারের আওতায় আনা প্রয়োজন। তাহলেই দেশ থেকে ধর্ষক ও খুনি নির্মূল সম্ভব হবে।
দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি আসকের : নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে যাত্রীবাহী বাসে একজন সেবিকাকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বেসরকারি মানাবধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। ঘটনার দ্রুত তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। একই সঙ্গে দ্রুত বিচারের আওতায় এনে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দোষীদের আইনানুগ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়েছে। গতকাল সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এই উদ্বেগ ও দাবি জানানো হয়।
প্রসঙ্গত, সোমবার রাতে ঢাকার মহাখালী থেকে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের পিরিজপুর রুটে চলাচলকারী ‘স্বর্ণলতা’ পরিবহনের বাসে সেবিকা শাহীনূর আক্তার তানিয়াকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনি কটিয়াদীর লোহাজুরি ইউনিয়নের বাহেরচর গ্রামের মো. গিয়াস উদ্দিনের মেয়ে। তানিয়া ইবনে সিনা হাসপাতালের কল্যাণপুর ক্যাম্পাসে সেবিকা পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি ঢাকা থেকে কটিয়াদী ও বাজিতপুরের পিরিজপুর হয়ে নিজ গ্রামে ফিরছিলেন। সোমবার রাতে বাজিতপুর উপজেলায় কিশোরগঞ্জ-ভৈরব আঞ্চলিক মহাসড়কের বিলপাড় গজারিয়ায় এ ঘটনা ঘটে।